
সূত্র – চট্টগ্রাম প্রতিদিন
চট্টগ্রামের চান্দগাঁও-বহদ্দারহাট এলাকায় কথিত বড় ভাইদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে বেপরোয়া কিশোর অপরাধীরা। আধিপত্য বিস্তার কিংবা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাতে গড়ে তোলা হচ্ছে যত্রতত্র কিশোর গ্যাং। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো বারবার উদ্যোগ নিলেও ক্রমেই বেসামাল হয়ে ওঠছে গ্যাংগুলো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধী তৈরির ‘মেশিন’ হলেন কথিত বড় ভাইয়েরা। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ায় নিয়ন্ত্রণে আসছে না কিশোর অপরাধ। ২০১৮ সালে পুলিশের তৈরি করা কিশোর গ্যাং তালিকায় ঝুঁকিপূর্ণ বা অপরাধপ্রবণ এলাকার শীর্ষে উঠে আসে চান্দগাঁও থানা।
২০১৯ সালে চান্দগাঁওতে কিশোর অপরাধীদের হাতে খুন হন তিনজন। বহদ্দারহাট হক মার্কেটের সিকিউরিটি গার্ড আব্দুর সবুর, দর্জি পাড়ায় কিশোর জিয়াদ ও ফরিদের পাড়ায় নুরুল আলম কিশোর অপরাধীদের ছুরিকাঘাতে মারা যান। এছাড়া শমসের পাড়ায় আমজাদ হোসেন নামে এক যুবকের দুই পা ড্রিল মেশিনে ছিদ্র করে দেওয়ার মত নৃশংস ঘটনা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।
shopping bag home delivery
সবশেষ গত সোমবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) চান্দগাঁও এলাকা থেকে কফিল উদ্দীন নামে এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে ১০ কিশোর গ্যাং সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এদের মধ্যে দুজনের কাছ থেকে দুটি ছুরিও উদ্ধার করা হয়। জানা গেছে, গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে কফিল উদ্দীন নামের ওই ব্যক্তি দুই নম্বর গেইট এলাকা থেকে বহ্দ্দারহাট যাওয়ার জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠেন। গাড়িটি বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের কাছে পৌঁছালে ছুরি ধরে কফিল উদ্দীনকে চান্দগাঁও সিঅ্যান্ডবি বিসিক শিল্প এলাকার একটি পরিত্যক্ত ভবনে নিয়ে আটক রাখে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। তারা কফিল উদ্দীনের কাছ থেকে মুক্তিপণ হিসেবে ৩০ হাজার টাকা দাবি করে। কফিলের কাছে থাকা ৭ হাজার ৮৫০ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় তারা। পরে কফিলের পরিবারের কাছ থেকে বিকাশে আরও ৫ হাজার টাকা নেয় তারা। এরপর কফিলকে ছেড়ে দেয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের পর পুলিশ কিশোর গ্যাংয়ের ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এরা হলেন— আহসান আহম্মেদ আকিব (১৯), মো. পারভেজ (১৯), জাহেদ উল্লাহ (২২), মো. আরমান (২০), মো. নয়ন (১৫), মো. আসিফ (১৫), মো. নিশাদ (১৭), মো. বাদশা (১৬), মো. কফিল উদ্দীন (১৫) ও মো. হৃদয় (১৭)।
এদিকে সম্প্রতি চাঁদা না দেওয়ায় শাহী আবাসিক এলাকার এক প্রবাসীর ভবনে মধ্যরাতে ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে একদল কিশোর। সিসিটিভি ফুটেজেও উঠে আসে তাদের তাণ্ডব। স্থানীয় কিশোর গ্যাং লিডার মাহাতাব কবির ওরফে মাহাতিরকে প্রধান আসামি করে চান্দগাঁও থানায় এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের হয়। গ্রুপটির বিরুদ্ধে ছিনতাই, মারামারি ও স্কুল কলেজের ছাত্রীদের উত্যক্ত করার অভিযোগ রয়েছে।
Din Mohammed Convention Hall
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বহদ্দারহাট মোড়কেন্দ্রিক বেপরোয়া কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করছে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ফ্রুট সোহেল। অপরাধ জগতে সোহেল একা নন, সমানে যুক্ত তার ভাই রুবেলও। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এমন কোনো বেআইনি কারবার নেই, যেখানে সোহেল জড়িত নন। বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারে হাঁটাচলার রাস্তায় মাছের দোকান বসিয়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে গ্রুপটি। হক মার্কেটের সামনে ফুটপাত ও সড়ক দখল করে শতাধিক দোকান বসিয়েছে। সড়ক দখল করেও বসানো হয়েছে পারমিটবিহীন গাড়ির স্ট্যান্ড।
গত ৩ নভেম্বর চান্দগাঁও বহদ্দারহাটের ত্রাস রাজু বাদশা ওরফে হামকা রাজু র্যাবের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন। তবুও কমেনি গ্রুপটির দৌরাত্ম্য। ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসায় সক্রিয় দীর্ঘদিন। বর্তমানে গ্রুপটি নিয়ন্ত্রণ করছেন রাজুর ভাই ধামা জুয়েল। তার বিরুদ্ধে দ্রুত বিচারসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। রাজু ও জুয়েল— এই দুই সহোদর এতটাই ভয়ংকর, কথায় কথায় অস্ত্র প্রদর্শন কিংবা গুলি চালানোর ঘটনা অহরহ ঘটিয়েছেন তারা।
২০১৮ সালে স্কুলছাত্র আদনান ইসফার হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিটি থানায় কিশোর গ্যাং তালিকা প্রস্তুত করেছিল নগর পুলিশ। সেই তালিকা অনুযায়ী অপরাধপ্রবণ এলাকার শীর্ষে রয়েছে চান্দগাঁও থানাধীন বহদ্দারহাট। মাঝেমধ্যে কেউ আটক হলেও নামমাত্র এসব অভিযানে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
সন্ধ্যা নামতেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে একদল কিশোর। কেউ নির্দিষ্ট স্পটে আবার কেউ মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ বুঝেই ছিনিয়ে নেয় টার্গেট ব্যক্তির নগদ টাকা, মোবাইল কিংবা জিনিসপত্র। প্রয়োজনে ছুরিকাঘাত কিংবা গুলি করতেও ভাবে না।
এমন একটি গ্রুপের নেতৃত্বে আছে বহদ্দারহাটের শাহাদাত হোসেন ওরফে ল্যাংড়া রিফাত। তার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা বিচারাধীন রয়েছে। মোটরসাইকেলে বিভিন্ন সড়কে ঘুরেফিরে ছিনতাই করে। অপর আরেকটি গ্রুপে আছে বাইশ বছর বয়সী ইমন বড়ুয়া। তিনি এতটাই দুর্ধর্ষ যে মুহূর্তের মধ্যে ৫-৬ টি ছিনতাই করে সটকে পড়ে। ইমন বড়ুয়া সবুর হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত প্রধান আসামি। ছিনিতাই, অস্ত্র ও মাদক আইনে তার বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
এছাড়া বহদ্দারহাটকেন্দ্রিক সন্ত্রাসী কার্যকলাপে অন্তত শতাধিক কিশোর সক্রিয়। তুচ্ছ বিষয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে যাওয়া কিংবা ছুরি-কিরিচ নিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করছে তারা। বেপরোয়া এসব কিশোর যে মাদকাসক্ত এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজি কিংবা নিজেই মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে যাচ্ছে।
সিপি
leave your comments