
চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধিঃ
দক্ষিন চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক উপ-শহর দোহাজারীর জমিদার, বিলুপ্ত দোহাজারী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও দোহাজারীর শহরায়নের স্বপ্নদ্রষ্টা স্বর্গীয় ভগীরথ সিংহ হাজারীর ১৩ মে ৪১ তম মৃত্যু বার্ষিকী। মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান সংক্ষিপ্ত পরিসরে স্মৃতি চারণ সভার আয়োজন করে থাকেন।
তিনি ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের হাজারী পরিবারের সর্বশেষ জমিদার। তার দান, অনুদান, প্রচেষ্টা অনুপ্রেরনা এবং পথ দেখিয়েছে দোহাজারীর আধুনিকায়নের, যার ফলশ্রুতিতে দোহাজারী পৌরসভা আজ দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক গুরুত্তপূর্ণ ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র । তাঁর বহুমুখী প্রতিভা এবং দূরদর্শিতা তাঁর কীর্তির মধ্যেই প্রতীয়মান। তাঁর কীর্তি শিক্ষাবিস্তার, সমাজসেবা এবং সামাজিক-সম্প্রীতি মূলক কর্মকান্ড, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা এবং তাঁর প্রভূত দান এবং সহায়তার মধ্যেই পরিলক্ষিত। এছাড়াও আছে তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনা, যেসব তাকে অভিষিক্ত করে সময়ের চেয়ে অতি অগ্রসর এক মহান ব্যক্তিত্ব। শিক্ষাবিস্তারে তাঁর আগ্রহের বাস্তবতার প্রমাণ, দোহাজারী জামিজুরি আঃ রহমান উচ্চ বিদ্যালয়। তিনি দোহাজারী জামিজুরি আঃ রহমান উচ্চ বিদ্যালয় এর প্রতিষ্ঠার সময়কার একজন দাতা এবং উদ্যোক্তা। এই স্কুল করার ব্যপারে তাঁর কীর্তি ,শুধু একজন দাতা এবং উদ্যোক্তা বললে অসমাপ্ত রয়ে যায়। দোহাজারী জামিজুরি আঃ রহমান উচ্চ বিদ্যালয় এর প্রতিষ্ঠাতা ও দোহাজারী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জনাব আঃ রহমান সর্বপ্রথম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন এবং সেইসময় ভগীরথ সিংহ হাজারী ছিলেন এই প্রতিষ্ঠা সফল করার প্রয়াসে অন্যতম সহায়ক এবং এই স্কুল প্রতিষ্ঠার সময়কার দানের সিংহ ভাগই ভগীরথ সিংহ হাজারী দান, এছাড়াও ছিল তাঁর অশেষ সামাজিক সহায়তা। দোহাজারী জামিজুরি আঃ রহমান উচ্চ বিদ্যালয়টি ৪ একর ভুমি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত,এই সম্পূর্ন ভুমি ভগীরথ সিংহ হাজারী নিজস্ব সম্পত্তি হতে দান এবং তৎকালীন স্কুল ভবন তৈরির জন্য আর্থিক সহায়তাও তাঁর অনেক। এই স্কুল প্রতিষ্ঠার সময়কাল ১৯৪৪ ,যে সময় অত্র এলাকায় কোন স্কুল তো ছিলই না, আশে পাশের বহুদূর পর্যন্তও ছিল না, সেই সময়কার প্রতিষ্ঠা এই স্কুল। বিশাল এই স্কুল আয়তন এবং আকারে বিশাল এবং এর এক উদ্দেশ্য ছিল দূর-দুরান্ত থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের স্থান সংকুলান করা। যার কারনে একটি সময়ে এই স্কুলের নামের সাথে “বহুমুখী” শব্দটি ব্যবহৃত হত। ভগীরথ সিংহ হাজারী যখন এই স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে উদ্যোগী হন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২/২৩ বছর। তৎকালীন চট্টগ্রাম কলেজ এর ইংলিশ এ অনার্স এর ছাত্র তিনি জানতেন এই গ্রামে শিক্ষা এবং শিক্ষা বিষয়ক উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা। এই স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা জনাব আঃ রহমানের উদ্যোগের সফলতা এই স্কুল এবং তাঁর সফলতার নিদর্শন স্বরূপ তার নাম, স্কুলের নামে যুক্ত। ভগীরথ সিংহ হাজারী দান এবং অসীম সহায়তা সত্তেও প্রচারবিমুখ মহান এই রাজসিক ব্যক্তিত্তের নাম স্কুলের নামের সাথে যুক্ত নয়, যা তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং মহত্তের নিদর্শন। দোহাজারি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আরেক কীর্তি,এই মহান ব্যক্তিত্বের। মহীরুহের ছায়ায় যেমনি ছোট গাছের নাম বিলীন হয়ে যায়, ঠিক তেমনি দোহাজারী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এর পাশের বিশাল দোহাজারী জামিজুরি আঃ রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের ছায়ায় এই স্কুলের ব্যাপারে ভগীরথ সিংহ হাজারী কীর্তি খুব একটা আলোচিত নয়। দোহাজারী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এর প্রতিষ্ঠার ব্যপারেও ভগীরথ সিংহ হাজারী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আর এই স্কুলের সম্পূর্ণ ভুমি, ভগীরথ সিংহ হাজারী ও দানু চেয়ারম্যানের নিজস্ব সম্পত্তি হতে দান। এই স্কুলও ১৯৪৪/৪৫ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত এবং সমসাময়িক কালে দোহাজারী তো বটেই আশে পাশের দূর দূরান্ত পর্যন্ত অন্য কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল না। এই বিদ্যালয়টি ভগীরথ সিংহ হাজারী প্রচেষ্টার ফল।
এই দুই বিদ্যালয়ের ঠিক সামনেই রাস্তার অপর পাশে অবস্থিত দোহাজারী সরকারি ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল। এই হাসপাতাল, ভগীরথ সিংহ হাজারী চেয়ারম্যান থাকা কালীন অবস্থায় তাঁর প্রচেষ্টায় এবং বলিষ্ঠনেতৃত্বে এই হাসাপাতাল প্রতিষ্ঠা হয়। এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল তৎকালীন সদর থানা পটিয়াতে। সেই হাসপাতাল, যখন অন্য কেউ বানানোর উদ্যোগ নেওয়ার ব্যপারে অনিশ্চিত এবং হাসপাতালের ভূমি পাওয়া নিয়ে শংকিত,তখন ভগীরথ সিংহ হাজারী নিজে এই দায়িত্ব নেন। তাঁর সেই উদ্যোগের ফসল এই হাসপাতাল। এই হাসপাতাল,তখনকার সময়ে পটিয়া থানার প্রধান সরকারি হাসপাতাল,যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দোহাজারীতে, ভগীরথ সিংহ হাজারী একক প্রচেষ্টা এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অবদান। তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালীন সকল কীর্তির মধ্যে এক অমর কীর্তি। তাঁর উদ্যোগে দোহাজারী ডাকঘরটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভগীরথ সিংহ হাজারী তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি দান করেন। তৎকালীন সময়ে এই ডাক ঘর অনেক দূর দুরান্ত পর্যন্ত ডাক সেবা দেওয়ার একমাত্র অবলম্বন ছিল। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক নিদর্শন , দোহাজারী জামে মসজিদ। এই মসজিদ এর ভূমিও ভগীরথ সিংহ হাজারী দান বা সহায়তা। তিনি নিজে হিন্দু-ধর্মাবলম্বী হয়েও দোহাজারীতে জামে মসজিদ বানানোর জন্য যখন ভুমি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়,সেই সময় তিনি নিজ উদ্যোগে ভুমি দান করতে চান। তাঁর এই সৎ ,সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সহায়তা সকলে আনন্দের সাথে গ্রহন করে। কিন্তু যখন দেখা যায় যে, বিধর্মীর দেওয়া দান নেওয়ায় সমস্যা ,তখন ভগীরথ বাবু এক টাকা হারে,লিজ হিসেবে সেটা মসজিদ কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করে।তিনি এসব ছাড়াও বিভিন্ন মন্দিরে সহায়তা করেছেন। আর্থিক অনুদান, সামাজিক সহায়তা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সাহায্য উনি বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে করেছেন। উন্নয়নে তৈরি করা তৎকালীন হাজারীহাট যা এখনকার হাজারী বাজার এ তাঁর স্থাপন করা হাজারী মার্কেট , যেগুলো পরবর্তীতে বিভিন্ন শপিং সেন্টার,আধুনিক মার্কেট হয়েছে। তিনি জানতেন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে ব্যবসায়িক কেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরী। তিনি সবসময় বলতেন, দোহাজারী এক সময় শহর হবে। আজকের এই আধুনিকদোহাজারী পৌরসভায় বসে এই কথা শুনতে খুবই স্বাভাবিক লাগে, কিন্তু তিনি যে সময় একথা বলে গেছেন সেই সময় দোহাজারী ছিল গন্ডগ্রাম। তাঁর বিভিন্ন কীর্তি দোহাজারীর শহরায়নের পথে সোপান হিসেবে কাজ করেছে। সময়ের চেয়ে অতি অগ্রসর এই মহান ব্যক্তিত্ব বুঝতে পেরেছিলেন শুধু ব্যবসায়িক প্রসার ঘটালেই হবে না, সামাজিক অবস্থানেও দোহাজারীকে এগিয়ে নিতে হবে। তাঁর তৈরি করা বিদ্যালয় সমূহ, হাসপাতাল, ডাকঘর ,মসজিদ, মন্দির,মার্কেট এবং দোকান সমূহ সেই সময়ে দোহাজারীকে সামাজিক অবস্থানে এগিয়ে নিয়েছে এবং এক জনবহুল কেন্দ্রে তৈরী করার ব্যপারে সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ রেখেছে।আর এই জনবহুল কেন্দ্রে পরিনত হওয়ার কারনে ব্যবসায়িক প্রসার ঘটেছে।আরঅত্র এলাকার শিক্ষা,চিকিৎসা, যোগাযোগ মাধ্যম সবকিছুর কেন্দ্রস্থল ছিল দোহাজারী। সময়ের চেয়ে অতি অগ্রসর এই মহান ব্যক্তিত্ব ঐ সময়ে যা পরিকল্পনা করে গেছেন,তা এখন বাস্তবায়িত হচ্ছে।তাঁর এই দূরদর্শী,সুদূরপ্রসারী,ব্যবসায়িক এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যকলাপ দোহাজারীর উন্নয়নের প্রধান স্তম্ভ।
মানুষের কাছে ভগীরথ সিংহ হাজারী প্রধান পরিচয় তিনি দাতা। যদিও তিনি ছিলেন একজন জমিদার,ব্যবসায়ী, চেয়ারম্যান। তবু মানুষের কাছে তিনি ছিলেন বিপদের বন্ধু, অনাশ্রয়ের আশ্রয়। তিনি ছিলেন তাঁর পূর্ববর্তী জমিদার বাবু মনোহর সিংহ হাজারী (যাকে সকলে চিনে,মহারাজ বাবু হিসেবে) এর ভ্রাতুষ্পুত্র এবং তৎ-পরবর্তী উত্তরসুরী, সাধারন মানুষের সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল খুবই কাছের। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসত তাঁর কাছেবিভিন্ন দরকারে,সহযোগিতা এবং আলোচনা/উপদেশের আশায়। বাবু ভগীরত সিংহ হাজারী দোহাজারীকে, দোহাজারীর মানুষকে ভালবেসেছেন। ভালবেসে করে গেছেন অগণিত উন্নয়নমূলক সহায়তা এবং কর্মকান্ড। তিনি ১৩মে এই কালজয়ী মানবীর মৃত্যু বরণ করেন, অনেক স্বপ্নদ্রষ্টা শুধু স্বপ্ন দেখেই ক্ষান্তহন, ভগীরথ সিংহ হাজারী তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের রুপরেখা এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গিয়েছিলেন। এই মহাত্মা জানতেন ,তাঁর জীবদ্দশায় না হলেও একদিন অবশ্যই তাঁর আশা এবং স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবেই । আজ দোহাজারী একটি উপজেলা না হয়েও পৌরসভা এবং অল্প কয়েকদিনের মধ্যেএকটি পুর্ণাংগ উপজেলা হবে এই আশা করা যায়। হয়তো সেইদিন খুব বেশি দূরে নেই, যেদিন দোহাজারী একটি পুর্ণাঙ্গ শহর হবে এবং বাবু ভগীরথ সিংহ হাজারীর স্বপ্ন পূরণ হবে এবং সেই স্বপ্নকেও ছারিয়ে যাবে।স্বর্গীয় শ্রী ভগীরথ সিংহ হাজারী’র মৃত্যু বার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।